আজকের পৃথিবীতে আলোচিত বিষয়গুলোর মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন সম্ভবত এক নম্বরে। বৈজ্ঞানিক সম্মেলন, প্রবন্ধ-প্রতিবেদন, টকশো আর রাউন্ড টেবিল বৈঠকের গণ্ডি ছাড়িয়ে এটা এখন মাঠ-পর্যায়ে আন্দোলনের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে
ক্ষতিগ্রস্ত একটি দেশের মানুষ হিসেবে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মনে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণগুলো সম্পর্কে স্পষ্ট ও সঠিক ধারণা থাকা দরকার। কিন্তু লক্ষণীয় যে, অজস্র সুযোগসন্ধানী প্রকল্প আর অবৈজ্ঞানিক আলোচনার ডামাডোলে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ সম্পর্কে অনেক ভুল ধারণা সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে। এ রকম ভুল ধারণার অনেক নমুনা আছে। প্রথমত, জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক উষ্ণতা ও গ্রিনহাউস প্রভাব-এ তিনটি বিষয়কে অনেকেই সমার্থক মনে করেন। আসলে এদের মধ্যে একটা কার্যকারণ সম্পর্ক থাকলেও, বিষয় তিনটি একেবারেই আলাদা। দ্বিতীয়ত, এমন ধারণা অনেকের মনেই প্রতিষ্ঠিত যে গ্রিনহাউস ইফেক্ট পৃথিবীর জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তৃতীয়ত, অনেকেই মনে করে বায়ুমণ্ডলের ওজনস্তরে ক্ষয়ের কারণে জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। চতুর্থত, অধিকাংশ মানুষ আধুনিক বিশ্বের কর্মকাণ্ডকেই জলবায়ু পরিবর্তনের একমাত্র কারণ মনে করে।
সহজ কথায় বলা যায়, গ্রিনহাউস ইফেক্টের কারণে নয় বরং গ্রিনহাউস গ্যাসের মাত্রাতিরিক্ত নিঃসরণের কারণে সাম্প্রতিককালে বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। গ্রিনহাউস ইফেক্ট আসলে কী? সূর্যের তাপ স্থল ও জলভাগস্থ সবকিছু ও বায়ুমণ্ডলকে উত্তপ্ত করে। এই তপ্ত স্থান বা বস্তুগুলো যখন ঠাণ্ডা হতে থাকে, তাদের শোষিত তাপ বিকিরিত হয়ে প্রধানত অবলোহিত বা ইনফ্রারেড রশ্মি হিসেবে বায়ুমণ্ডলে ফিরে যায়। পৃথিবীর বায়ুস্তরে কিছু গ্যাসীয় উপাদান ও কণা পদার্থ (পার্টিকুলেট ম্যাটার) আছে, যেগুলো এই বিকিরিত তাপ শুষে নিয়ে ও ধারণ করে ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি থাকা বায়ুস্তর অর্থাৎ ট্রপোস্ফিয়ারকে উষ্ণ করে তোলে। এ প্রক্রিয়াটি পৃথিবীকে বসবাসের যোগ্য উষ্ণ রাখে এবং জীবজগতকে সুরক্ষিত রাখে ঠিক একটি গ্রিনহাউসের মতো। এক কথায় একেই বলে গ্রিনহাউস ইফেক্ট। তাপ শোষণ ও ধারণের ক্ষেত্রে জরুরি ভূমিকা পালন করে বলে জলীয়বাষ্প, কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড, ওজন, ক্লোরোফ্লুরোকার্বন ইত্যাদি বায়বীয় পদার্থকে ‘গ্রিনহাউস গ্যাস’ নামে ডাকা হয়। বর্তমানে ভূপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। গ্রিনহাউস ইফেক্ট যদি না থাকত, ভূপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা হতো হিমাঙ্কের ১৮ ডিগ্রি নিচে। হিমশীতল পৃথিবীর বুকে তরল আকারে কোনো পানির অস্তিত্ব থাকত না। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের গঠন ও গ্রিনহাউস ইফেক্টের কারণেই পৃথিবীর বুকে আজও লাখ লাখ জীববৈচিত্র্যের উদ্ভব ঘটে চলেছে। সুতরাং গ্রিনহাউস ইফেক্টকে ক্ষতিকর বা অপ্রয়োজনীয় কোনো প্রক্রিয়া ভাবার অবকাশ নেই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির ও সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে বায়ুমণ্ডলে তাপশোষী কিছু গ্রিনহাউজ গ্যাস ও কার্বন কণার নির্গমন ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। কারণ বিদ্যুৎ উৎপাদন, যানবাহন চলাচল ও শিল্প-কারখানায় উৎপাদনের জন্য যথেচ্ছভাবে পোড়ানো হচ্ছে কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস ও পেট্রোলিয়ামজাত জ্বালানি। এতে উপজাত হিসেবে বাতাসে নির্গত হচ্ছে প্রচুর পরিমাণে কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন ও ব্ল্যাক কার্বন। এদিকে কৃষিকাজ, পশুচারণ, নগরায়নসহ নানা উদ্দেশ্যে বন কেটে উজাড় করা হচ্ছে। ফলে কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করার মতো বনাঞ্চলের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমে আসছে। আর এভাবেই বায়ুমণ্ডলের গড় উষ্ণতা স্বাভাবিকের চেয়ে একটু একটু করে বেড়ে চলেছে। এ বিষয়টিকে এক কথায় বলা হয় বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি বা গ্লোবাল ওয়ার্মিং।
গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য, উপাত্ত ও মডেলনির্ভর হিসেবে দেখা যাচ্ছে, ১৮৮০ সাল অর্থাৎ শিল্প বিপ্লবের কিছুকাল পর পর্যন্তও বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ ২৬০ থেকে ২৮০ পার্টস পার মিলিয়ন (পিপিএম)-এর মধ্যে উঠানামা করেছে। কিন্তু ১৯৮৯ সাল নাগাত বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ নিরাপদ মাত্রা (৩৫০ পিপিএম) ছাড়িয়ে গেছে। এর প্রায় কাছাকাছি সময় থেকে পৃথিবীর বাৎসরিক গড় তাপমাত্রাও আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে চলেছে। সাম্প্রতিক তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী প্রতি বছরই আগের বছরের তুলনায় বেশি উষ্ণ হয়ে উঠেছে। তবে বৈশ্বিক উষ্ণতার সঙ্গে ওজনস্তরে ক্ষয়ের কোনো সরাসরি সম্পর্ক নেই। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ঘটে বায়ুমণ্ডলের ট্রপোস্ফিয়ারে। অর্থাৎ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে শুরু করে ১৪ কিলোমিটার উচ্চতার মধ্যে এই পরিবর্তন সীমাবদ্ধ থাকে। আর ওজনস্তরের অবস্থান হচ্ছে ট্রপোস্ফিয়ারে অর্থাৎ ১৪ থেকে ৫০ কিলোমিটার উচ্চতায়। মূলত মানুষের তৈরি ক্লোরোফ্লুরোকার্বনের ফটোকেমিক্যাল বিক্রিয়ার কারণে ওজনস্তরে ক্ষয় হয়। কিন্তু বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়া বা কমায় এর কোনো ভূমিকা নেই।
বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাবে আগের চেয়ে ঘনঘন সামুদ্রিক ঝড় হচ্ছে। পৃথিবীর শুকনো অঞ্চলগুলোতে আগের চেয়ে বেশি বৃষ্টি ও বৃষ্টিজনিত বন্যা হচ্ছে। আর আর্দ্র অঞ্চলগুলো হয়ে পড়ছে আগের চেয়ে শুকনো। এ ধরনের পরিবর্তনগুলোকে এক কথায় বলা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় মেরু অঞ্চলের বরফস্তর বা হিমালয়-আল্পসের মতো পর্বতমালার হিমবাহ অথবা সমুদ্রে ভাসমান বরফের বিশাল খণ্ডগুলো গলে যাচ্ছে। ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের উপকূলীয় নিচু এলাকাগুলো নোনাপানির নিচে ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছে। ফলে অনেক জীববৈচিত্র্য হারিয়ে যাচ্ছে। আর মানুষ হারাচ্ছে তার বাসস্থান, কৃষিজমি ও নিরাপত্তা।
মানুষ উন্নত বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন প্রাণী। অসহায়ের মতো ভবিতব্যকে সে মেনে নিতে পারে না। আধুনিক মানুষ জীবনযাপনের প্রায় সব প্রতিকূলতাকে জয় করেছে। অজানাকে জেনেছে। জীবজগতের ওপরে এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। আর এভাবেই নিজের জীবনকে করে তুলেছে সুখ-স্বাছন্দ্যময়। কিন্তু বিজ্ঞান চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, আধুনিক মানুষের কার্যকলাপের কারণেই পৃথিবী স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক দ্রুত উষ্ণ হয়ে উঠেছে। গত ত্রিশ বছর ধরে এই উষ্ণায়নের মাত্রা বেড়েই চলেছে। বিপন্ন হয়ে উঠেছে আমাদের ও পরবর্তী প্রজন্মের জীবন এবং অন্যান্য জীববৈচিত্র্যে অস্তিত্ব। সাম্প্রতিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারণ অর্থাৎ বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ঘটছে মানুষের কর্মকাণ্ডের কারণেই। তাই ঘটমান বিপর্যয় ঠেকাতে ও মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে জলবায়ুবিজ্ঞানীদের সঙ্গে এখন পরিবেশ আইনপ্রণয়নকারী ও পরিবেশবাদী সংস্থাগুলোও হাত মিলিয়েছে। প্রতিটি মানুষকেই এখন প্রকৃতি, পরিবেশ ও জলবায়ু সম্পর্কে জরুরি বিষয়গুলো স্পষ্টভাবে জানতে হবে। আর জানতে হবে প্রতিটি মানুষ কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তনরোধে অবদান রাখতে পারে। আর সেটা তাকে করতে হবে আজ এবং এখন থেকেই।
লেখক : বায়ুমণ্ডল ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ, অধ্যাপক- এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়